দক্ষিণ আফ্রিকার ইরানের সাথে সখ্যতা: বিশ্ব মঞ্চে এক সাহসী পদক্ষেপ?

দক্ষিণ আফ্রিকা, বর্ণবাদ-পরবর্তী যুগে একসময় পশ্চিমের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত ছিল, বর্তমানে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে এক নতুন পথ বেছে নিচ্ছে। দীর্ঘদিনের মিত্রদের ছেড়ে কিছু নির্দিষ্ট দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার এই প্রবণতা বিশ্বজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষত, তেহরানের সঙ্গে তাদের ক্রমবর্ধমান নৈকট্য বহু পর্যবেক্ষকের ভ্রু কুঁচকে দিয়েছে। এই পদক্ষেপ শুধু পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তাদের ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করছে না, বরং একটি জটিল আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

এই সখ্যতার মূলে রয়েছে গভীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। দক্ষিণ আফ্রিকা বরাবরই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ও স্বাধীকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, এবং বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে ইরানসহ অনেক অ-পশ্চিমা দেশ থেকে নৈতিক সমর্থন পেয়েছিল। সেই ঐতিহাসিক কৃতজ্ঞতা এবং স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করার আকাঙ্ক্ষা থেকেই হয়তো দক্ষিণ আফ্রিকা বর্তমানে এমন সাহসী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তারা একটি বহুমুখী বিশ্বের কল্পনা করে, যেখানে ক্ষমতা শুধুমাত্র কয়েকটি প্রভাবশালী দেশের হাতে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সকলের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে।

ইরানের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার এই নিবিড় সম্পর্ক কেবল সাংস্কৃতিক বা অর্থনৈতিক আদান-প্রদানে সীমাবদ্ধ থাকছে না, বরং কৌশলগত দিকেও প্রসারিত হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং আঞ্চলিক প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। এমন পরিস্থিতিতে দক্ষিণ আফ্রিকার ইরান-মুখিতা পশ্চিমের কাছে তাদের ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি এমন এক উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ খেলা, যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকা একদিকে তাদের স্বাধীন অবস্থান ধরে রাখতে চাইছে, অন্যদিকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং রাজনৈতিক চাপকে উপেক্ষা করছে।

এই নতুন কৌশলগত সম্পর্কের ফলস্বরূপ দক্ষিণ আফ্রিকাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কঠিন মূল্য দিতে হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বন্ধন হুমকির মুখে পড়তে পারে, যা দেশটির অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। পশ্চিমা বিনিয়োগ ও বাণিজ্য চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। উপরন্তু, বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার দিক থেকেও এই ধরনের জোট নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করে উত্তেজনা বাড়াতে পারে, যা একটি শান্ত ও স্থিতিশীল বিশ্বের জন্য মোটেই ভালো খবর নয়।

সুতরাং, দক্ষিণ আফ্রিকার এই পদক্ষেপকে কেবল একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির অংশ হিসেবে দেখা যায় না, বরং এটি একটি অত্যন্ত জটিল ভূ-রাজনৈতিক দাবার চাল। অতীতকে সম্মান জানিয়ে ভবিষ্যৎ নির্ধারণের এই প্রক্রিয়ায় তারা একদিকে যেমন নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রমাণ করতে চাইছে, অন্যদিকে তেমনি তাদের সিদ্ধান্তগুলো বিশ্বের ক্ষমতা ভারসাম্যকে প্রভাবিত করছে। সামনে দক্ষিণ আফ্রিকাকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে: ঐতিহাসিক সখ্যতা বজায় রেখে পশ্চিমা বিশ্বের আস্থা অর্জন করা, নাকি নিজেদের পথে হেঁটে এক নতুন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার অংশীদার হওয়া। এই ‘গ্যাম্বেল’ এর চূড়ান্ত ফলাফল বিশ্ব দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

উৎস: https://menafn.com/1109960980/South-Africas-Iran-Gamble-A-Risky-Alliance-Threatening-US-Ties-And-Global-Stability

সর্বশেষ লেখা