সম্প্রতি ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে সংবিধানের ঐতিহাসিক এক সংশোধনী নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির এক জ্যেষ্ঠ নেতা দাবি করেছেন, ১৯৭৬ সালের ৪২তম সাংবিধানিক সংশোধনী, যা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে আনা হয়েছিল, তা সংবিধান প্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেদকরের মূল দর্শনকে “সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস” করে দিয়েছে। এই মন্তব্য একদিকে যেমন ইতিহাসকে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এনেছে, তেমনই দেশের সাংবিধানিক কাঠামোর ওপর এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে চিন্তাভাবনার অবকাশ তৈরি করেছে।
৪২তম সংশোধনীকে প্রায়শই ‘ক্ষুদ্র সংবিধান’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়, কারণ এর মাধ্যমে সংবিধানের বিভিন্ন মৌলিক অংশে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছিল। বিশেষ করে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের মতো শব্দগুলো প্রস্তাবনায় যুক্ত করা হয়, যা নিয়ে আজও মতবিরোধ বিদ্যমান। সমালোচকদের মতে, এই সংশোধনী বিচার বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করে নির্বাহী শাখার কর্তৃত্ব বাড়িয়েছিল, যা গণতান্ত্রিক ভারসাম্য নষ্ট করার ঝুঁকি তৈরি করেছিল। জরুরি অবস্থার প্রেক্ষাপটে এই সংশোধনী পাস হওয়ায় এর বৈধতা ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
এই সংশোধনী কেবল শব্দ বা অনুচ্ছেদের পরিবর্তন ছিল না, এটি ছিল দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর এক গভীর প্রভাব। সংবিধানকে একটি জীবন্ত দলিল হিসাবে দেখা হলেও, ৪২তম সংশোধনী এমন কিছু মৌলিক পরিবর্তন এনেছিল যা এর মূল আত্মা ও উদ্দেশ্যকে অনেকটাই বদলে দিয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই। এই বিতর্ক বর্তমান সময়ে কেবল রাজনৈতিক বাগ্যুদ্ধ নয়, বরং এটি দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনার প্রতিফলন।
তবে, সংবিধান একটি গতিশীল দলিল, যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পরিবর্তনের সীমা কতদূর? ৪২তম সংশোধনী সম্ভবত সেই সীমাকে অতিক্রম করেছিল, যা পরে ‘মৌলিক কাঠামো’ মতবাদের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ করা হয়। এই মতবাদ অনুযায়ী, সংবিধানের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা কোনো সংশোধনী দ্বারা পরিবর্তন করা যাবে না। এই ঐতিহাসিক বিচারিক সিদ্ধান্তই নিশ্চিত করেছে যে সংবিধানের মূল সুর যেন অক্ষত থাকে, এবং ভবিষ্যতে কোনো সরকার তার সুবিধা অনুযায়ী ব্যাপক পরিবর্তন আনতে না পারে।
শেষ পর্যন্ত, সংবিধানের ৪২তম সংশোধনী নিয়ে এই চলমান বিতর্ক কেবল একটি ঐতিহাসিক আলোচনা নয়, এটি বর্তমান প্রজন্মের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, একটি জাতির গণতান্ত্রিক কাঠামো কতটা সংবেদনশীল এবং এর সুরক্ষার জন্য কতটা সতর্কতা প্রয়োজন। সংবিধান কেবল আইনের একটি বই নয়, এটি একটি জাতির সম্মিলিত স্বপ্ন ও আদর্শের প্রতিচ্ছবি। এর প্রতিটি শব্দ এবং অনুচ্ছেদের পেছনে রয়েছে এক সুদূরপ্রসারী চিন্তা, যার সম্মান বজায় রাখা সকলেরই কর্তব্য।